হাফিজ মাওলানা শায়খ এনামুল হক: জীবন ও কর্ম
হাফিজ মাওলানা এনামুল হক সাহেব ১৯৭৭ সালে
সিলেটের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলার ৮নং কসকনকপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত ঐতিহ্যবাহী মামরখানী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কারি মুতাহির আলী (র:) অত্যন্ত সাদাসিধে একজন পরহেজগার বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। সাত ভাই ও দুই বোনের মধ্যে শায়খ এনামুল হক সবার ছোটো।
জানা যায়, হাফিজ মাওলানা এনামুল হকের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া ফয়জে আম মুন্সিবাজার মাদ্রাসায়। এখান থেকেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। অতঃপর শাহ সাহাবুদ্দিন হাফিজিয়া মাদরাসার হিফজ বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে প্রধানশিক্ষক হাফিজ ইলয়াস সাহেবের নিকট ২৪ পারা পর্যন্ত হিফজ করেন। সেখান থেকে জামিয়া মুহাম্মাদিয়া হাড়িকান্দী মাদ্রাসার হিফজ শাখায় ভর্তি হন। হাড়িকান্দীর প্রাচীন উসতাজ হাফিজ মুস্তাকিম আলী সাহেবের নিকট হিফজ সমাপ্ত করে আজাদ দ্বীনি এদারায়ে তালিম বোর্ডের অধীনে ১৪১৩ হিজরিতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং চূড়ান্ত ফলাফলে বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
তিনি ১৯৯২ সালে ‘মকসুদ বখত স্মৃতি পরিষদ’ আয়োজিত সিলেট বিভাগীয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে চূড়ান্ত ফলাফলে প্রথম স্থান অধিকার করে ব্যাপক প্রশংসিত হন।হিফজুল কুরআন সমাপ্তির পর হাড়িকান্দী মাদরাসার কিতাব বিভাগের মিজান ( ৭ম) শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর শরহে জামি (সানুভি ২য়) পর্যন্ত অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে লেখাপড়া করেন। অতঃপর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য চলে যান সিলেটস্থ জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া ভার্থখলায়। সেখানে মুখতাসার (সানুভি ৩য়) থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ২০০১ সালে তাকমিলের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরই সাথে সমাপ্ত হয় তাঁর কওমি অঙ্গনের লেখাপড়া। জ্ঞানপিপাসু মাওলানা এনামুল হক কওমির পাশাপাশি সরকারি মাদরাসায়ও সমান্তরালভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যান। দুবাগ দাখিল মাদরাসা থেকে দাখিল, গঙ্গাজল হাসানিয়া সিনিয়র মাদরাসা থেকে আলিম, সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা থেকে ফাজিল ও কামিল যথাক্রমে ২০০১ ও ২০০৩ সালে সমাপ্ত করে শিক্ষাজীবনের ইতি টানেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হাফিজ মাওলানা এনামুল হক শিক্ষকতা দিয়েই তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ২০০৩ ও ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জামিয়া মা’ ছুমিয়া ইসলামিয়া, মাছিমপুর সিলেটের বিভাগীয় প্রধানশিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি তখন সিলেট শহরের সুবিদবাজার লন্ডনি রোড জামে মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালে তিনি লন্ডন চলে যান এবং বর্তমানে সেখানে স্বপরিবারে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। সেখানে তিনি ধর্মীয় , সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। তিনি লন্ডনের মেনর পার্ক বাইতুর রাহমান জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব। এছাড়া তিনি আন্তর্জাতিক চ্যারিটি সংস্থা দারুল ইহসান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
হাফিজ মাওলানা এনামুল হক দীনের প্রচার ও প্রসারের কাজে নিজের মেধা, সময় ও শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তাঁর বায়তুর রাহমান জামে মসজিদের মাসিক তাফসির মাহফিলে নিয়মিত সারগর্ভ তাফসির পেশ করেন। পাশাপাশি প্রতি জুমুআয় খুতবার আগে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সামসময়িক প্রেক্ষাপট নিয়ে দিকনির্দেশনামূলক বয়ান পেশ করেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার নিমন্ত্রণে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি ও স্পেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামি কনফারেন্সে যোগদান করে হৃদয়গ্রাহী বয়ান পেশ করে ইতিমধ্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন।
তিনি যুগ সচেতন আলেম হিসেবে দ্বীনের বহুমুখী খেদমতে নিয়োজিত আছেন। অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনেও সমান বিচরণ রয়েছে হাফিজ মাওলানা এনামুল হকের। তিনি লন্ডনের জনপ্রিয় টিভি-টিভি ওয়ান-এর নিয়মিত আলোচক। তাঁর এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইউরোপের ঘরে ঘরে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়েছে এবং ঘরে বসেই মুসলমানরা শুনতে পাচ্ছে আল-কুরআনের মর্মবাণী। তাছাড়া ইউটিউবসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় একটু সার্চ করলেই ভেসে আসে তাঁর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত বিষয়ভিত্তিক বয়ান। এগুলোর মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম খুঁজে পাচ্ছে ইসলামি জীবন পরিচালনার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা।
শায়খ মাওলানা এনামুল হক আপাদমস্তক আখেরাতমুখী আলেমেদ্বীন। ফিদায়ে মিল্লাত আল্লামা আসআদ মাদানি রাহ-এর হাতে তিনি বায়আত ছিলেন। তাঁর ইনতিকালের পর মুরাজাআত করেন হাকিম আখতার সাহেব রাহ.-এর খলিফা শায়খ আছগর হোসাইন সাহেবের কাছে। তাঁর তত্ববধানেই তিনি তাসাউফ ও সুলুকের মেহনত চালিয়ে যাচ্ছেন এবং ইতিমধ্যে তিনি শায়খ আছগর হোসাইন সাহেবের কাছ থেকে খিলাফতের ইজাজাতও লাভ করেছেন। বায়তুর রাহমান জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত দ্বিমাসিক খানকার যাবতীয় ইনতিজাম ও তত্ত্বাবধান তিনি নিজেই করেন।
হাফিজ মাওলানা এনামুল হক ২০০৩ সালে লন্ডন বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে ফিদায়ে মিল্লাত আল্লামা আসআদ মাদানি রাহ.-এর একমাত্র খলিফা ও প্লাস্টু জামিয়া ইসলামিয়া-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল হজরত মাওলানা শায়খ তরিকুল্লাহ সাহেবের মেয়ের সঙ্গে শুভ পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর এক ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় মেয়ে সায়িদা ফারহিন হক কওমি মাদরাসার সিলেবাস অনুযায়ী দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করার পাশাপাশি এ লেভেলও কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন। এরপর মেডিকেল সাইন্সে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ লাভ করেন। বর্তমানে তিনি কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে মেডিকেল সাইন্সে অধ্যয়নরত। দ্বিতীয় মেয়ে সিদ্দিকা তাহসিন হক ও তৃতীয় মেয়ে সাফওয়ানা তারাহহুম হক নবম শ্রেণিতে মাদ্রাসা ও স্কুলের সম্মনিত সিলেবাসে লেখাপড়া করছেন। এছাড়া একমাত্র ছেলে আহসানুল হক একাদশ শ্রেণিতে লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রাইভেটভাবে হিফজুল কুরআনও চালিয়ে যাচ্ছেন।
হাফিজ মাওলানা এনামুল হক সিলেটের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ জামিয়া মোহাম্মাদিয়া হাড়িকান্দী মাদরাসায় ২০১৬ থেকে ২০২১-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তাঁর সময়ে মাদরাসাকে ঢেলে সাজালে সিলেট জেলার সর্বত্র তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। হাড়িকান্দী মাদরাসার শতবার্ষিকী আন্তর্জাতিক মহা-সম্মেলন তাঁরই নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এই মহা-সম্মেলনে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান উলামায়ে কিরাম ও স্কলারগণ উপস্থিত হন। তাঁদের সামনে তিনি মাদরাসার সার্বিক অবস্থা তুলে ধরার ফলে সারা বাংলাদেশেই এই মাদরাসা ও তাঁর সফলতার কথা আলোড়িত হতে থাকে। তিনি ছিলেন সফল ও স্বনামধন্য প্রিন্সিপাল। তাঁর দায়িত্বকালে মাদরাসাটি ঈর্ষণীয় সাফল্য ও ভেতর-বাহির সবদিক দিয়ে উন্নয়নের ছোঁয়া পায়। এছাড়া তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের কয়েকটি মাদরাসার সদরে মুহতামিম ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দীনি খিদমাত আনজাম দিয়ে যাচ্ছেন। বলাবাহুল্য, মাওলানা এনামুল হক তাঁর দ্বীনি খেদমতকে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে নতুন একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি ১ ফেব্রুয়ারী ২০২১ সালে জকিগঞ্জ পৌরসভায় অস্থায়ীভাবে “জামিয়া দারুল ইহসান’ নামে একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। অবশেষে ২০২৪ সালে জকিগঞ্জের বারঠাকুরী ইউনিয়নের অন্তর্গত সোনাসার বাজারের অদূরে নিজস্ব ৮০ শতক ভূমির উপর গড়ে তুলেন স্বপ্নের জামিয়া দারুল ইহসানের স্থায়ী ক্যাম্পাস। বিশাল এই ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ এখনো চলমান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে ইতোমধ্যে দাখিল ৬ ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত চালুর পাশাপাশি হিফয শাখাও চালু করা হয়েছে। মাদরাসায় আবাসিক ও অনাবাসিক উভয় ব্যবস্থাই চালু আছে।
কথায় আছে, ‘ বৃক্ষ তোমার নাম কী / ফলে পরিচয়।’ মাদ্রাসাটি চালুর পর থেকে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার অধীনে কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বারবার মেধা তালিকায় স্থান করে নিচ্ছে। ২০২১ সালে ১ম, ২য় ও ৩য় স্থান অর্জন এবং ২০২৩ সালে ২য় স্থান! মাদ্রাসার সূচনালগ্নেই এমন অর্জন গোটা সিলেটবাসীকে আলোড়িত করেছে ।
একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ঠ যে, স্বপ্নের সাধক শায়খ এনামুল হক। বহুমাত্রিক স্বপ্নে তিনি বিভোর থাকেন। স্বাপ্নিক পথ চলায় তিনি ইসলামের সবদিকের খিদমাতে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে লেখালিখির জগতে পা রাখেন। তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। তিনি ইতোমধ্যে ‘আহসানুল বয়ান ‘ নামক একটি গ্রন্থ লিখে মুসলিম সমাজে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছেন। আমরা আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে তাঁর জন্য দোয়া করি। তিনি সুস্থতার সাথে বেঁচে থাকুন দীর্ঘকাল। আমিন।