- সাহসী আলেম শায়েখ মাওলানা আব্দুল গণী (র:)

শায়খ আব্দুল গণী (রহ.) ছিলেন সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা, দ্বীনি কার্যক্রম এবং ওয়াজ মাহফিলে সাহসী বক্তব্য দানের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৪৩ সালের ১লা মার্চ জকিগঞ্জ উপজেলার ৩নং কাজলসার ইউনিয়নের অন্তর্গত জামুরাইল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম মোঃ ইনছান আলী এবং মাতার নাম মরহুমা সজিবা খাতুন।
হযরত শায়খ আব্দুল গণী (র:) এর শিক্ষাজীবন ছিল বড়ই বৈচিত্র্যময়। শৈশবকাল থেকেই দ্বীনি শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল । তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সে হাড়িকান্দি মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং ৬ মাসের মধ্যে ইবতেদায়ী স্তরের ৫ বছরের সিলেবাস সম্পন্ন করে বসেন! পরে কানাইঘাট উপজেলার সড়কের বাজার আহমদিয়া মাদ্রাসায় ৭ম শ্রেণী থেকে আলিম জামাত পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৬১ সালে জকিগঞ্জের ইছামতি দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে আলিম পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর গাছবাড়ি জামেউল উলুম কামিল মাদ্রাসায় ফাজিল (১৯৬৩) ও কামিল (১৯৬৫) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। গাছবাড়ি মাদ্রাসায় থাকাকালীন তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের প্রখ্যাত মুহতামীম হযরত মাওলানা ক্বারী তৈয়ব (রহ.) এর তত্ত্বাবধানে হাদীসের উপর বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।
যতদূর জানা যায়, শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ১৯৬৩ সালে হাড়িকান্দি মাদ্রাসার মুহতামীম নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি মাদ্রাসার মজলিসে শুরা ও মজলিসে আমেলা গঠন, ঘন্টা-রুটিন, শিক্ষকদের স্তর বিন্যাস, কুতুবখানা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠাসহ যাবতীয় সংস্কার সাধন করে মাদ্রাসাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। পরে কিছুদিন গাছবাড়ি মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি বড়লেখা সুজাউল আলিয়া মাদ্রাসা ও বিয়ানীবাজার সিনিয়র মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বিয়ানীবাজার সিনিয়র মাদ্রাসায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮৯ সালে সিলেট নগরীর বন্দরবাজার জামে মসজিদের খতিব হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং ১ বছর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বিভিন্ন কারণে নিয়মিত খতিবের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলেও অনিয়মিতভাবে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন আমৃত্যু।
শায়খ মো. আব্দুল গণী রহ. দ্বীনি শিক্ষার বিস্তারের লক্ষ্যে মদীনাতুল উলুম দারুসসুন্নাহ জামুরাইল কামালপুর মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এটা নির্মাণ করেন আমাদের পশ্চাদপদ নারীদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে। এছাড়া তাঁর হাত ধরেই জামেয়া মোহাম্মদীয়া হাড়িকান্দি মাদ্রাসায় নারীশিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। একজন তীক্ষ্ণ ধীশক্তিসম্পন্ন আলেমেদ্বীন হিসেবে তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে,নারী সমাজকে অবহেলিত রেখে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ একেবারেই অসম্ভব। তিনি আধুনিক হাড়িকান্দি মাদ্রাসার রূপকারও। এছাড়া তিনি অসংখ্য মাদ্রাসার মুহতামিম পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন। জামিয়া ইসলামিয়া আরজানিয়া শরীফাবাদ, জামেয়া ছায়ীদীয়া মাইজকান্দি মাদ্রাসা, ষাইটষৌলা মাদ্রাসা ও পল্লীশ্রী কওমি মাদ্রাসা এর মধ্যে অন্যতম। তবে তিনি উল্লেখিত মাদ্রাসাগুলোর দায়িত্ব নিয়েই বসে থাকেননি।তিনি যে কোনো কওমী মাদ্রাসাকেই নিজের মনে করতেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়াজ মাহফিলে তাঁর উপস্থিত হওয়া ছিল সেই প্রতিষ্ঠানের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় । তাঁর পুরো জীবনে দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারে যে ভুমিকা পালন করেছিলেন তা পুঙ্খানুপুঙ্খ লেখতে গেলে পৃথক একটি গ্রন্থ রচনার প্রয়োজন।
শায়খ আব্দুল গণী (র:) এর জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি কওমী মাদ্রাসার দু’টি শিক্ষা বোর্ডেরও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মজলিসে শুরা সদস্য ও সিলেট ভিত্তিক ‘নগর বোর্ড-এর সভাপতি।
তিনি কওমি অঙ্গনের ওয়াজ মাহফিলের অন্যতম আর্কষণ ছিলেন। তাঁর বক্তৃতায় ত্যাগ-নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও বাতিলের বিরুদ্ধে অগ্নিঝরা জ্বালাময়ী বক্তব্য ছিল। তাঁর সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি সিলেট অঞ্চলে দ্বীনি শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সুদূর যুক্তরাজ্যেও মসজিদ-মাদ্রাসা তৈরি করেছিলেন। দেশের ভিতরে বিয়ানীবাজার কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে তাঁর ভুমিকার কথা ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে লেখা থাকবে। দীর্ঘ ১৮ বছরের দায়িত্বপালন কালে তাঁর হাত ধরেই এই মসজিদের অভাবনীয় উন্নতি হয়।
শায়খ আব্দুল গণী (রহ.) ছিলেন একজন মুজাহিদে মিল্লাত- যিনি তাঁর জীবন ও কর্মের মাধ্যমে দ্বীনি সমাজে অমর হয়ে আছেন। তিনি দ্বীনের বহুমুখী খেদমতের পাশাপাশি ইলমে তাসাউফের জগতেও বেশ প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষক ছিলেন আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী ( র:)-যিনি ‘বরুণার পীর ছাব’ হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। ১৯৭১ সালে বরুণার পীর সাহেব কর্তৃক তিনি ইলমে তাসাউফের ইজাজত প্রাপ্ত হন। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, তাঁর অবদান সিলেট অঞ্চলের মুসলিম সমাজে চিরস্মরণীয় থাকবে।
ক্ষণজন্মা এই মনীষী মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল ( মঙ্গলবার) বিকাল ৫টায় সিলেট নগরীর সিলকো টাওয়ারের নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। এরই মধ্য দিয়ে ঘটে একটি সাহসী সময়ের অবসান।
একজন আলেমের মৃত্যু মানে একটি পৃথিবীর মৃত্যু। আগামী বিশ্বে এমন সাহসী হকপন্থী আলেম তৈরি হবেন কি-না তা আল্লাহ জানেন। উল্লেখ্য যে, মৃত্যুর সময় তিনি চার স্ত্রী, দশ ছেলে ও আট মেয়ে রেখে গেছেন। তার বড় ছেলে মাওলানা ওলীউর রহমান, দ্বিতীয় ছেলে হাফিজ জিল্লুর রহমান ও তৃতীয় ছেলে মুহাম্মদ সাদিকুর রহমান যুক্তরাজ্যে রয়েছেন । চতুর্থ ছেলে হাফিজ মাওলানা সিদ্দীকুর রহমান কানাডায় অবস্থান করছেন। জামেয়া মোহাম্মদীয়া হাড়িকান্দি ও তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত মদীনাতুল উলুম দারুস্সুন্নাহ জামুরাইল কামালপুর মাদ্রাসা পরিচালনা করছেন তাঁরই সুযোগ্য পুত্র মদিনা ইউনিভার্সিটির স্কলার আল্লামা মুফতি হামিদুর রহমান মাদানী।
আমরা দোয়া করি, আল্লাহপাক হযরত শায়খ মো. আব্দুল গণী (রহ.) এর কবরকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দিন। আমিন।